ছাত্রাবস্থায় কলেজের নাটকে নিয়মিত অভিনয় দিয়ে যুবকটির যাত্রা শুরু। পিতা রাজেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তাঁর জন্ম। মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। বাবাকে হারানোর ফলে প্রথম জীবনে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করতে হয়েছে। নাটকের নেশা তাঁর এত তীব্র ছিল যে অর্ধাশনে অনশনে দিন কাটিয়েও মঞ্চে অভিনয় করেছেন। এমনই এক অভিনয়ের সময় মঞ্চে পড়ে গিয়ে যুবকটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ডাক্তার আসেন। তিনি এই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে অপুষ্টিজনিত দুর্বলতার কথাই উল্লেখ করেন। সেই সময় লিটল থিয়েটার গ্রুপের সভাপতি সতীকান্ত গুহ তাঁকে মাসিক ৪০০ টাকার বেতনে সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ করেন। সেই যুবকটি উত্তরকালে মঞ্চে এবং চলচ্চিত্রের দাপুটে অভিনেতা হয়ে ওঠেন।তিনি হলেন শেখর চট্টোপাধ্যায়। ১৯২৪ সালের ৫ মে নদীয়া জেলার ধর্মদহ গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
সমসাময়িক আরেক অভিনেতা উৎপল দত্ত ভাগনাস নাট্য সংস্থার সঙ্গে যুবকটিকে পরিচয় করিয়ে দেন। ভাগনাস এ থাকার সময় নির্বাচনে পোস্টার ড্রামা করেছেন ‘ভোটের ডেট’ ইত্যাদি নাটকগুলিতে। উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার গ্রুপে যোগদান করেন এবং বেশ কয়েকটি নাটকে অসাধারণ অভিনয় করেন শেখর। সেই তালিকায় আছে “ম্যাকবেথ”(ম্যাকডাস চরিত্রে), “ওথেলো”(ইয়াগো চরিত্রে)। মিনার্ভা থিয়েটারে যখন “কল্লোল” নাটক চলছে তখন সেখানে তিনি শার্দুল সিং চরিত্রটিতে প্রাণবন্ত অভিনয় করেছেন।
যখন রিচার্ড এটেনবরা “গান্ধী” ছবিটি এইখানে নির্মাণ করছেন তখন সেখানে শেখর চট্টোপাধ্যায় সুযোগ পেয়েছিলেন সুরাবদ্দির চরিত্রে অভিনয়ের। বেশ কয়েকটি হিন্দি ছবিতে তিনি কাজ করেছেন। শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত হরি হন্ডল বর্গাদার, অনুগ্রহম, কন্ডুরা প্রভৃতি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন।তাঁর গল্প ও চিত্রনাট্য নিয়ে মঞ্জু দে ছবি পরিচালনা করেছিলেন “স্বর্গ হতে বিদায়”।
পি এল টিতে শেখরের অভিনয় দেখে পরিচালক জ্যোতির্ময় রায় উৎপল দত্ত মারফত ডেকে পাঠান শেখর চট্টোপাধ্যায়কে। সুযোগ পান “টাকা আনা পাই” ছবিতে। প্রায় সেই সময় পেলেন অগ্রদূত গোষ্ঠীর “সবার উপরে” ছবিতে কাজ করার সুযোগ। ১৯৬২ সালে ডাক পেলেন সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে “অভিযান” ছবিতে রামেশ্বর চরিত্রের জন্য। সঙ্গে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ওহাদিয়া রেহমান, রবি ঘোষের মতো স্বনামধন্য শিল্পী। ক্লিক করে গেল ছবিটি। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি শেখর চট্টোপাধ্যায়কে। সত্যজিৎ রায় তাঁকে আবারও নিয়েছিলেন “চিড়িয়াখানা” ছবিতে। বাংলার সব প্রায় সব বিখ্যাত পরিচালকের ছবিতেই তিনি কাজ করেছেন। মৃণাল সেন তাঁকে নিয়েছেন ইন্টারভিউ, কোরাস, এক আধুরে কাহানি (হিন্দি) প্রভৃতি ছবিতে।তরুণ মজুমদারের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন ঠগিনী, সংসার সীমান্তে, অমর গীতি, কুহেলি প্রভৃতি ছবিতে। তবে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন তিনি চিত্রগ্রাহক পরিচালক দীনেন গুপ্তের সঙ্গে। দীনেন গুপ্তের সঙ্গে শেখরের অভিনয়ের ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে প্রথম প্রতিশ্রুতি, আজকের নায়ক, মর্জিনা আবদাল্লা, শ্রাবণ সন্ধ্যা, সঙ্গিনী, দেবী চৌধুরানী, রাগ অনুরাগ, নিশিমৃগয়া, রজনী, শঠে শাঠ্যং প্রভৃতি।
মূলত খল চরিত্রের জন্যই তিনি বেশি ডাক পেতেন। আবার অন্যান্য চরিত্রও তিনি সাবলীল ছিলেন। তাঁর অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে জোড়া দীঘির চৌধুরী পরিবার, একই অঙ্গে এত রূপ, অভিশপ্ত চম্বল, গড় নাসিমপুর, মহাবিপ্লবী অরবিন্দ, আমি সিরাজের বেগম, রক্ত তিলক, রোদন ভরা বসন্ত, দাবি, মায়াবিনী লেন, সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা, মৌচাক, স্বীকারোক্তি, এই পৃথিবী পান্থনিবাস, প্রতিমা, বারবধূ, সমাপ্তি, বৌমা, সম্রাট ও সুন্দরী, জজ সাহেব, তৃষ্ণা, রাজা, প্রভৃতি ছবি।
যখন রিচার্ড এটেনবরা “গান্ধী” ছবিটি এইখানে নির্মাণ করছেন তখন সেখানে শেখর চট্টোপাধ্যায় সুযোগ পেয়েছিলেন সুরাবদ্দির চরিত্রে অভিনয়ের। বেশ কয়েকটি হিন্দি ছবিতে তিনি কাজ করেছেন। শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত হরি হন্ডল বর্গাদার, অনুগ্রহম, কন্ডুরা প্রভৃতি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন।তাঁর গল্প ও চিত্রনাট্য নিয়ে মঞ্জু দে ছবি পরিচালনা করেছিলেন “স্বর্গ হতে বিদায়”। তাঁর স্মরণীয় চরিত্রাভিনয়ের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় “দেবী চৌধুরানী” ছবিতে রঙ্গলালের ভূমিকায়। নাম ভূমিকায় ছিলেন সুচিত্রা সেন। “মর্জিনা আবদুল্লা” ছবিতে কাসেমের চরিত্রে। শেখর চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত প্রথম ও শেষ ছবি হল “বসুন্ধরা”। ১৯৮৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবি শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক বাংলা ছবি হিসেবে রজতকমল পুরস্কার পেয়েছিল। এ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, লিলি চক্রবর্তী প্রমুখ শিল্পী অভিনয় করেছেন।
পেশাদারী মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশ্বরূপা থিয়েটারে “সাহেব বিবি গোলাম” নাটকে তিনি ছোট বাবুর চরিত্রে অভিনয় করতেন। বিপরীতে পটেশ্বরীর চরিত্রে অভিনয় করতেন সুপ্রিয়া দেবী। পেশাদারী মঞ্চ, রেডিও নাটক, দূরদর্শন ধারাবাহিকে তিনি অংশ নিয়েছেন। চিত্রনাট্য, নাটক লিখেছেন। দূরদর্শনের জন্য তৈরি করেছিলেন টেলিফিল্ম” সীমানা”। উৎপল দত্তের সঙ্গে মতান্তর হেতু তিনি যখন লিটল থিয়েটার গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন ১৯৫৮ সালে নিজেই গড়ে তোলেন “থিয়েটার ইউনিট”। ১৯৬০ সালের ২৭ আগস্ট বিয়ে করেন অভিনেত্রী সাধনা রায়চৌধুরীকে। তাঁদের এক কন্যা। থিয়েটার ইউনিটের হয়ে বিজন থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করেছেন “জজ সাহেব” এবং” শ্রীমতি ভয়ংকরী” এই নাটক দুটিতে। থিয়েটার ইউনিট এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর সাধনা রায়চৌধুরী, তিনি এবং আরও কয়েকজন মিলে নতুন একটি নাট্য সংস্থা গঠন করেন। তার নাম দেন “ইউনিটি থিয়েটার”(১৯৮৩)। ম্যাক্সমুলার ভবনের টাকায় নাটক করেন এই অভিযোগে একসময় তাঁকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল।
হংকংয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ব্রেখট সেমিনারে তাঁর “পন্তু লাহা” খ্যাতি লাভ করেছিল (১৯৮৬)।সংগীত নাটক একাডেমির পুরস্কার তিনি পেয়েছেন ১৯৮৯ সালে। ১৯৭১ সালে ইউরোপ, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে, ১৯৭৫ সালে ইউরোপ, ১৯৮১ সালে হংকং, ১৯৮৬ সালে আবার হংকং তিনি ভ্রমণ করেছেন। এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শিল্পী শেখর চট্টোপাধ্যায় আমাদের ছেড়ে চলে যান ১৯৯০ সালের ৬ এপ্রিল। জন্ম শতবর্ষের বছরে শিল্পীর উদ্দেশে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।